সুরা-আল-ইমরান
আয়াত-২০০
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু
قَالَ رَبِّ اجْعَل لِّي آيَةً ۖ قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ إِلَّا رَمْزًا ۗ وَاذْكُر رَّبَّكَ كَثِيرًا وَسَبِّحْ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ
৪১। তিনি আরয করিলেন, হে আমার রব! আমার জন্য কোন লক্ষণ নির্ধারণ করুন। আল্লাহ্ বলিলেন, তোমার লক্ষন ইহাই যে, তুমি মানুষের সহিত কথা বলিতে সমর্থ হইবে না তিন দিন পর্যন্ত ইশারা ব্যতীত। আর স্বীয় প্রভূর প্রচুর পরিমাণে যেকের করিও আর তাসবীহ পাঠ করিও অপরাহ্নেও পূর্বাহ্নেও।
৪২। আর যখন ফেরেশতাগণ বলিলেন, হে মারইয়াম! নিশ্চয়, আল্লাহ্ তোমাকে মনোনীত করিয়াছেন এবং পবিত্র করিয়াছেন এবং নির্বাচিত করিয়াছেন বিশ্বজগতের নারীগণের মোকাবেলায়।
يَا مَرْيَمُ اقْنُتِي لِرَبِّكِ وَاسْجُدِي وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ
৪৩। হে মারইয়াম! আনুগত্য করিতে থাকো স্বীয় রবের এবং সেজদা করিতে থাক, আর রুকু করিতে থাক রুকুকারীদের সঙ্গে।
৪৪। এই ইতিবৃত্ত গায়েবী সংবাদসমূহের অন্যতম, আমি ইহার ওহী প্রেরণ করিতেছি আপনার নিকট। আপনি তখন তাহাদের নিকট ছিলেন না, যখন তাহারা স্ব স্ব কলমসমূহ নিক্ষেপ করিতেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তাহদের মধ্যে কোন ব্যক্তি মারইয়মের প্রতিপালন করিবে। আর আপনি তখনও তাহাদের নিকট ছিলেন না, যখন তাহারা পরস্পর মতবিরোধ করিতেছিল।
৪৫। (ঐ সময়কে স্মরণ কর) যখন ফেরেশতাগণ বলিলেন, হে মারইয়াম! নিশ্চয়, আল্লাহ্ তোমাকে সু-সংবাদ দিতেছেন একটি কলেমার যাহা আল্লাহর তরফ হইতে হইবে। তাঁহার নাম হইবে মাসীহ্ ঈসা-ইবনে মারইয়াম। সম্মানিত হইবেন ইহলোকে এবং পরলোকে এবং সান্নিধ্য প্রাপ্তগণের অন্তর্ভূক্ত হইবেন।
শানে নুযুলঃ
১। হযরত ইয়াহইয়া যখন স্বীয় মাতৃগর্ভে পয়দা হন, তখন হযরত যাকারিয়ার বয়স ছিল ১০০ বৎসর, আর তাঁহার স্ত্রীর বয়স বয়স ছিল ৯৮ বৎসর। (মুঃকোঃ)
২। মারইয়ামের মাতা স্বীয় স্বপ্ন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করিলে বাইতুল মুকাদ্দাসের তাপসগণ সকলেই মারইয়ামের প্রতি পালনের ভার গ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিরলেন। অবশেষে সাব্যস্ত হইল, প্রত্যেকে নিজ নিজ কলম-যাহা দ্বারা তাওরাত লিখা হইত, প্রবাহিত পানিতে নিক্ষেপ করিবেন। তাহাই করা হইল। সকলের কলম ভাটির দিকে বহিয়া চলিল, কিন্তু হযরত যাকারিয়ার কলম উজাইয়া আসিল। সুতরাং তিনিই মারইয়ামের প্রতিপালনের ভার প্রাপ্ত হইলেন। (বঃকোঃ)
وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ
৪৬। আর মানুষের সহিত কথা বলিবেন দোলনার মধ্যে এবং প্রাপ্তবয়সে এবং সুসভ্য লোকদের অন্তর্ভূক্ত হইবেন।
৪৭। মারইয়াম বলিলেন, হে আমার রব! কিরূপে আমার সন্তান হইবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ নাই! আল্লাহ্ বলিলেন, এইরূপেই হইবে, আল্লাহ্ যাহা ইচ্ছা করেন, সৃষ্টি করিয়া দেন। যখন কোন কার্যকে পূর্ণ করিতে ইচ্ছা করেন, তখন উহাকে বলেন, হইয়া যাও, ব্যাস উহা হইয়া যাও।
৪৮। আর আল্লাহ্ তাঁহাকে শিক্ষা দিবেন কিতাব এবং জ্ঞানগর্ভ কথা এবং তাওরাত ও ইঞ্জীল ।
৪৯। আর তাঁহাকে বনী ইসরাঈলের প্রতি ( পয়গম্বর করিয়া) প্রেরণ করিবেন, আমি তোমাদের নিকট প্রভূ হইতে (স্বীয় নুবুওয়্যাতের) যথেষ্ট প্রমাণ লইয়া আসিয়াছি তাহা এই যে, আমি তোমাদের জন্য কাদার দ্বারা এইরূপ আকার গঠন করি যেমন পক্ষীর আকৃতি হইয়া থাকে। অতঃপর উহাতে ফুৎকার দেই, তাহাতে উহা পক্ষী হইয়া যায় আল্লাহর আদেশে। আর আমি আরোগ্য করি জন্মান্ধকে এবং কুষ্ঠ রোগীকে এবং জীবিত করি মৃতকে আল্লাহর আদেশে। আর তোমাদিগকে বলিয়া দেই, যাহাকিছু নিজেদের ঘরে খাও এবং যাহা রাখিয়া আস। নিশ্চয়, ইহার মধ্যে তোমাদের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ আছে যদি তোমরা ঈমান আনিতে চাও।
শানে নুযুলঃ
১। অর্থাৎ, নুবুওয়্যাতের নিদর্শন স্বরুপ তাঁহাকে এই মু’জেযা দেওয়া হইবে যে, মাত্র কয়েক দিনের শিশু বয়স্ক লোকের ন্যায় জ্ঞানগর্ভ কথা বলিবেন। (মুঃকোঃ)
২। হযরত ঈসা মাটি দ্বারা চামচিকার আকৃতি প্রস্তুত করিয়া উহার মুখে আল্লাহর নামে ফুঁ দেওয়া মাত্র উহা উড়িয়া যাইত। (মুঃকোঃ)
৩। হযরত ঈসা(আঃ) জন্মান্ধ লোকের চোখে এবং শ্বেত-কুষ্ঠ রোগীর দেহে আল্লাহর নাম লইয়া হাত মুছিয়া দিলে তাহারা আরোগ্য লাভ করিত। ঔষধ ব্যবহারে বা স্বাভাবিক উপায়ে জন্মান্ধতা এবং শ্বেত-কুষ্ঠ রোগ ভালো হইতে পারে। কিন্তু ঔষধ স্বাভাবিক উপায় ব্যতীত আরোগ্য লাভ করিলে উহাকে মু’জেযা বলা হয়। (বঃকোঃ)
وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ ۚ وَجِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ
৫০। আর আমি আসিয়াছি আমার পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের সমর্থনকারীরূপে, আর এই জন্য আসিয়াছি যে, হালাল করিয়া দিব তোমাদের জন্য কতিপয় এমন বস্তু যাহা তোমাদের প্রতি হারাম করা হইয়াছিল। আর আমি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে (নুবুওয়্যাতের) প্রমাণ লইয়া তোমাদের নিকট আসিয়াছি। মোটকথা, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর, আর আমার কথা মানিয়া লও।
৫১। নিশ্চয়, আল্লাহ্ আমারও রব তোমাদেরও রব! সুতরাং তোমরা তাঁহার এবাদত কর; ইহাই সরল পথ।
فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَىٰ مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
৫২। অনন্তর যখন ঈসা তোমাদের মধ্যে কুফর দেখিতে পাইলেন, তখন তিনি বলিলেন,এমনও কেহ আছে কি, যে আমার সাহায্যকারী হইবে আল্লাহ্র পথে? হাওয়ারীগণ বলিল, আমরাই আল্লার সাহায্যকারী হইব। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনিলাম। আর আপনি একথার সাক্ষী থাকুন যে, আমরা ফরমাবরদার।
৫৩। হে আমাদের রব! আমরা ঈমান আনিয়াছি উহার প্রতি যাহা আপনি নাযিল করিয়াছেন, আর আনুগত্য অবলম্বন করিয়াছি আমরা রসুলের, সুতরাং আমাদিগকে তাহাদের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করুন, যাহারা সমর্থনকারী।
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
৫৪। আর তাহারা গোপন ষড়যন্ত্র করিল এবং আল্লাহ্ গোপন কৌশল করিলেন। আর আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।
إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَىٰ إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ۖ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
৫৫। যখন আল্লাহ্ বলিলেন, হে ঈসা! নিশ্চয়, আমি তোমাকে মৃত্যু দান করিব এবং তোমাকে (আপাততঃ) নিজের দিকে উঠাইয়া লইতেছি এবং আমি তোমাকে ঐসকল লোক হইতে পবিত্র করিব যাহারা প্রত্যাখ্যান করে। আর যাহারা তোমার কথা মানে তাহাদিগকে বিজয়ী করিব উহাদের উপর যাহারা প্রত্যাখ্যানকারী, কিয়ামতদিবস পর্যন্ত। অতঃপর আমরাই দিকে হইবে সকলের প্রত্যাবর্তন। তৎপর আমি তোমাদের মধ্যে মীমাংসা করিয়া দিব ঐ সমস্ত বিষয়ে যাহাতে তোমরা পরস্পর মতভেদ করিতেছিলে।
শানে নুযুলঃ
১। হযরত ঈসা (আঃ) যখন বুঝিতে পারিলেন যে, ইহুদীরা আমার দ্বীন কবুল করিবে না, তখন তিনি মিসরে পলাইয়া গেলেন এবং একদল “হাওয়ারীকে” নিজের ধর্মে দ্বীক্ষিত করিলেন। “হাওয়ারী” অর্থ ধোপা। ইহারাই হযরত ঈসার সাহায্য কারী হইয়াছিলেন। (মুঃকোঃ)
২। ইহুদীরা হযরত ঈসা (আঃ) কে গেরেফতার করিয়া একটি গৃহে আবদ্ধ করিয়া রাখিল। পরদিন ভোরে তাঁহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া আনার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠান হইল। অবশ্য পূর্ব-রাত্রিতেই আল্লাহ্ ঈসাকে আসমানে উঠাইয়া নিয়াছিলেন। সুতরাং প্রেরিত লোকটি ঈসাকে না পাইয়া সংবাদ দিতে আসিল-ঈসা নাই। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাহার আকৃতি অবিকল ঈসার আকৃতি করিয়া দিলেন; সে বাহিরে আসিতেই সকলে তাহাকে ধরিল। অবশেষে তাহাকে শূলে চড়াইয়া ও পাথর মারিয়া হত্যা করিয়া ফেলিল। এই হইল তাহাদের ষড়যন্ত্রের শাস্তি। (মুঃকোঃ)
فَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ
৫৬। সুতরাং যাহারা কাফের ছিল, বস্তুতঃ আমি তাহাদিগকে কঠোর শাস্তি প্রদান করিব ইহলোকেও এবং পরলোকেও। আর তাহাদের কোন সাহায্যকারী হইবে না।
وَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
৫৭। আর যাহারা মুমিন ছিল এবং নেক আমল করিয়াছিল, ফলতঃ আল্লাহ্ তাহাদিগকে তাহাদের ছওয়াব দান করিবেন। আর আল্লাহ্ যালেমদের সহিত ভালবাসা রাখেন না।
ذَٰلِكَ نَتْلُوهُ عَلَيْكَ مِنَ الْآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ
৫৮। ইহা আমি আপনাকে পড়িয়া পড়িয়া শুনাইতেছি, যাহা প্রমাণসমূহের অর্ন্তর্ভূক্ত এবং জ্ঞানগর্ভ বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত।
৫৯। নিশ্চয়, ঈসার আশ্চর্য অবস্থা আল্লাহর নিকট আদমের আশ্চর্য অবস্থার ন্যায়। তাঁহাকে মাটি দ্বারা তৈয়ার করিলেন, তৎপর তাঁহা (র-কালেব) কে বলিলেন, (সজীব) হইয়া যাও, তখনই তাহা (সজীব) হইয়া গেল।
৬০। এই বাস্তব ঘটনা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হইতে; সুতরাং আপনি সংশয়ীদের অন্তর্ভূক্ত হইবেন না।
শানে নুযুলঃ
১। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তা‘আলা আদমকে পিতা ও মাতা ব্যতীত পয়দা করিয়াছেন। তাঁহাকে ইহারা খোদার পুত্র বলে না। আর যিনি শুধু পিতা ব্যতীত পয়দা হইয়াছেন তাঁহাকে কেমন করিয়া খোদার পুত্র বলিতেছে? আল্লাহ্ তো মাতা-পিতা উভয়কে ব্যতীতই মানুষ পয়দা করিবার ক্ষমতা রাখেন, তবে শুধু পিতা ছাড়া পয়দা করাতে আশ্চর্যের কি আছে? (মুঃকোঃ)
২। নাছারারা হুযুরের (দঃ) সহিত এ বিষয়ে ঝগড়া করিতেছিল যে, হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা নহে বরং আল্লাহর পুত্র। আর যদি ঈসা আল্লাহর পুত্র না হন, তবে আপনিই বলুন কাহার পুত্র? দুনিয়াতে কি পিতা ব্যতীত কাহারও জন্ম হইতে পারে? ইহারই উত্তরে এই আয়াতটি নাযিল হয়। (মুঃকোঃ)