তাওহীদের উপর ইনতিকাল করবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে

যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর ইনতিকাল করবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে- এর প্রমাণ:-

৪৩) আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বা ও যুহায়র ইবনে হারব রহ…উসমান রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে ইনতিকাল করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

৪৪) মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর আল-মুকাদ্দামী রহ…উসমান রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে অনুরূপ বলতে শুনেছি…বাকি অংশ পূর্ববর্তী হাদীসের অনুরূপ।

৪৫) আবূ বকর ইবনে নাযর ইবনে আবূ নাযর রহ…আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে একটি সফরে ছিলাম। এক পর্যায়ে দলের রসদপত্র নি:শেষ হয়ে গেল। পরিশেষে রাসূল (সা) তাদের কিছু সংখ্যক উট যবেহ করার মনস্থ করলেন। রাবী বলেন যে, এতে উমর রাযি. আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি আপনি সকলের অবশিষ্ট রসদ সামগ্রী একত্র করে আল্লাহর কাছে দু‘আ করতেন! রাসূল (সা) তাই করলেন। যার কাছে গম ছিল সে গম নিয়ে এবং যার কাছে খেজুর ছিল সে খেজুর নিয়ে হাযির হলো. (তালহা ইবনে মুসাররিফ বলেন) মুজাহিদ আরো বর্ণনা করেন যে, যার কাছে খেজুরের আঁটি ছিল, সে তাই নিয়ে হাযির হলো। আমি (তালহা) আরয করলাম, আঁটি তারা দিয়ে কি করতেন? তিনি বললেন, তা চুষে পানি পান করতেন। বর্ণনাকারী বললেন, তারপর রাসূল (সা) সংগৃহীত খাদ্য সামগ্রীর উপর দু‘আ করলেন। রাবী বলেন, অবশেষে লোকেরা রসদে নিজেদের পাত্র পূর্ণ করে নিল। রাবী বলেন যে, তখন রাসূল (সা) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লহর রাসূল। যে এ দু‘টি বিষয়ের প্রতি সন্দেহাতীত বিশ্বাস রেখে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে, সে জান্নাতে দাখিল হবে।

৪৬) সাহল ইবনে ‘উসমান ও আবূ কুরায়ব মুহাম্মদ ইবনে আ‘লা রহ…আবূ হুরায়রা রাযি. অথবা আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, (সন্দেহ রাবী আমাশের) তাবূকের যুদ্ধের সময় লোকেরা দারুণ খাদ্যাভাবে পতিত হলো। তারা আরয করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা আমাদের উটগুলো যবেহ করে তার গোশত খাই এবং চর্বি ব্যবহার করি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, যবেহ করতে পার। রাবী বলেন, ইত্যবসওে উমর রাযি. আসলেন এবং আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি এরূপ করা হয়, তাহলে বাহন কমে যাবে; বরং আপনি লোকদেরকে তাদেও উদ্ধৃত্ত রসদ নিয়ে উপস্থিত হতে বলুন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে বরকতের দু‘আ করুন। আশা করা যায়, আল্লাহ তাতে বরকত দিবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হ্যাঁ, তাই হবে। তিনি একটি দস্তরখান আনতে বললেন এবং তা বিছালেন। এরপর সকলের উদ্ধৃত্ত রসদ চেয়ে পাঠালেন। রাবী বলেন, তখন কেউ এক মুঠো ভুট্টা নিয়ে হাযির হলো, কেউ এক মুঠো খেজুর নিয়ে হাযির হলো, কেউ বা এক টুকরা রুটি নিয়ে আসল, এভাবে কিছু পরিমাণ রসদ-সামগ্রী দস্তরখানে জমা হলো। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) বরকতের দু‘আ করেন। তারপর তিনি বললেন, তোমরা নিজ নিজ পাত্রে রসদ ভর্তি করে নাও। সকলেই নিজ নিজ পাত্র ভরে নিল, এমনকি এ বাহিনীর কোন পাত্রই আর অপূর্ণ রইল না। এরপর সকলে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করলেন। কিছু উদ্ধৃত্ত রয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। যে ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে এ কথা দু’টির উপর বিশ্বাস রেখে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে, সে জান্নাত থেকে বাধাপ্রাপ্ত হবে না।

৪৭) দাউদ ইবনে রুশায়দ রাযি…উবাদা ইবনে সামিত রাযি. থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি বলবে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল, ঈসা আ. আল্লাহর বান্দা ও তাঁর দাসীর পুত্র, তাঁর কথা দ্বারা পয়দা হয়েছেন যা তিনি মারয়ামের মধ্যে ঢেলে ছিলেন ( অর্থাৎ কালেমায়ে ‘কুন’ দ্বারা মারয়ামের গর্ভে তাঁকে পয়দা করেছেন) তিনি তাঁর আত্মা, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য। সে ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাতের আটটি তোরণের যেখান দিয়ে সে চাইবে প্রবেশ করাবেন।

একটি প্রশ্ন: হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. কর্তৃক বর্ণিত সৃষ্টির শুরু সম্পর্কীয় হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক জান্নাতী মানুষের জন্য জান্নাতে প্রবেশের নির্দিষ্ট দরজা থাকবে। আর নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অথচ আলোচ্য হাদীসের আলোকে বুঝা যাচ্ছে যে, জান্নাতী ব্যক্তি আট দরজার যেটিকে দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। তো বাহ্যিক দৃষ্টিতে হাদীস দুটি সাংঘার্ষিক বলে মনে হচ্ছে। এর জবাব কী?
জবাব: প্রত্যেকের জন্য জান্নাতের প্রবেশের দরজা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকবে। আটটি দরজার যে কোনোটি দিয়ে প্রবেশ করার এখতিয়ার প্রদান করা হবে তার সম্মানার্থে। এখতিয়ার দেওয়ার পরে তার অন্তরে ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করার আগ্রহ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে যেটি তার জন্য পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

৪৮) আহমদ ইবনে ইবরাহীম আদ-দাওরাকী রহ…উমায়র ইবনে হানী রাযি, এর সূত্রে এ সনদে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তার বর্ণনায় একটু পার্থক্য দেখা যায়। তিনি বলেন, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সে যে আমলের উপর থাকুক না কেন। “জান্নাতের আটটি তোরণের যেটি দিয়ে সে চাইবে প্রবেশ করবে” কথাটি তিনি উল্লেখ করেন নি।

একটি প্রশ্ন : অনেক হাদীস দ্বারা একথা স্বীকৃত যে, গুনাহগার মুমিন আপন কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করবে। প্রথম পর্যায়ে জান্নাতে যেতে পারবে না। অথচ আলোচ্য হাদীসের দ্বারা বাহ্যত একথাই বুঝে আসে যে, গুনাহগার মুমিনও প্রথম পর্যায়েই জান্নাতে যেতে পারবে। তাহলে আলোচ্য হাদীস এবং অন্যান্য হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হবে কীভাবে?

জবাব:
ক. আলোচ্য হাদীস দ্বারা ঈমান এবং কালিমায়ে শাহাদাতের মৌলিক প্রভাব এবং বৈশিষ্ট্যের কথা বলা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কালিমায়ে শাহাদাত এবং ঈমানের প্রভাব এতটাই যে, তা জাহান্নামের আগুনকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য হারাম করে দেয়। তবে এই প্রভাব কার্যকর হওয়ার জন্য যেমন নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে‘ কিছু বাধা । শর্ত পাওয়া গেলে এবং বাধা না থাকলেই মূলত উল্লিখিত প্রভাব কার্যকর হওয়া সম্ভব।

খ. ফরজ আমল এবং আদেশ নিষেধের আহকাম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা) এই হাদীস বর্ণনা করেছেন।

গ. ঈমানদার মুমিন জান্নাতে যাবে- এই ধারার অবস্থাটি বর্ণনা করাই আলোচ্য হাদীসের উদ্দেশ্য। যে গুনাহগার হবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলা উপর ন্যাস্ত। তিনি চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দিয়ে তাকে প্রথম পর্যায়েই জান্নাত দান করতে পারেন। অন্যথায় শাস্তি ভোগ করার পর সে জান্নাতে যাবে।

৪৯) কুতায়বা ইবনে সাঈদ…উবাদা ইবনে সামিত রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, সুনাবিহী রহ. বলেন, আমি উবাদার কাছে গেলাম, তখন তিনি মৃত্যু শয্যায় ছিলেন, আমি কেঁদে ফেললাম। তিনি আমাকে বললেন, থাম, কাঁদছ কেন? আল্লাহর শপথ! যদি আমাকে সাক্ষী বানানো হয়, তাহলে আমি তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবো, যদি আমাকে সুপারিশকারী বানানো হয়, তাহলে অবশ্যই আমি তোমার জন্য সুপারিশ করব এবং যদি আমার সাধ্য থাকে, তবে আমি তোমার উপকার করব। তারপর উবাদা রাযি. বলেন, আল্লাহর শপথ!আমি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে শ্রুত সব হাদীসই তোমাদের শুনিয়েছি, যাতে তোমাদের কল্যাণ রয়েছে, তবে একটি ছাড়া, তোমাদের কাছে সেটা আজ বর্ণনা করছি, কেননা আজ আমি মৃত্যুর দুয়ারে উপস্থিত। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তাঁর জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন।

৫০) হাদ্দাব ইবনে খালিদ আল-আযদী রহ…মু’আয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি এক সময় নবী করিম (সা) এর বাহনের পিছনে বসা ছিলাম। আমার ও নবী করিম (সা) এর মাঝে হাওদার কাষ্ঠখন্ড ছাড়া আর কোন ব্যবধান ছিল না। নবী করিম (সা) বললেন, হে মু‘আয ইবনে জাবাল! আমি বললাম ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! বান্দা হাযির; আপনার আনুগত্য শিরোধার্য! তারপর তিনি কিছুদুর অগ্রসর হয়ে আবার বললেন,হে মু‘আয ইবনে জাবাল! আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! বান্দা আপনার খিদমতে হাযির, আপনার আনুগত্য শিরোধার্য, তারপর তিনি কিছু দূরে অগ্রসর হয়ে বললেন, হে মু‘আয ইবনে জাবাল! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! বান্দা আপনার খিদমতে হাযির, আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। তিনি বললেন, তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহ তা’আলার কী হক রয়েছে? আমি আরয করলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না! তারপর কিছু দুর চললেন। নবী করিম বললেন, হে মু‘আয ইবনে জাবাল! আমি আরয করলাম, বান্দা আপনার খিদমতে হাযির, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। নবী করিম (সা) বললেন, তুমি কি জানো, এগুলো করলে আল্লাহর কাছে বান্দার কী হক আছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। নবী করিম (সা) বললেন, তা এই যে, তিনি তাকে শাস্তি দেবেন না।

৫১) আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বা রহ…মু‘আয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি এক সফরে রাসূলুল্লাহ (সা) এর গাধা-উফায়রের পিছে তাঁর পিছনে বসা ছিলাম। রাসূল (সা) বললেন, হে মু‘আয! তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহর হক কী এবং আল্লাহর উপর বান্দার হক কী? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কোন শরীক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো, যে তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না, তাকে তিনি শাস্তি দিবেন না। মু‘আয রাযি. বললেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি লোকদের এ সংবাদ জানিয়ে দেব? তিনি বললেন, না। লোকদের এ সংবাদ দিও না। দিলে এর উপরই তারা ভরসা করে বসে থকবে।

৫২) মুহাম্মদ ইবনে মুসান্না ও ইবনে বাশশার রহ…মু‘আয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূল (সা) বললেন, হে মু‘আয! তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কী হক? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল (সা) বললেন, তা হলো যেন আল্লাহরই ইবাদত করা হয় এবং তাঁর সঙ্গে যেন অন্য কিছু শরীক না করা হয়। তিনি বললেন, তুমি কি জানো, তা করলে আল্লাহর কাছে বান্দার হক কী? মু‘আয রাযি. বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তাদের তিনি শাস্তি দেবেন না।

৫৩) কাসিম ইবনে যাকারিয়া রহ…মু‘আয রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলাম। তিনি বললেন, তুমি কি জানো, মানুষের উপর আল্লাহর হা কী?…বাকী অংশ উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ।

৫৪) যুহায়র ইবনে হারব রহ…আবূ হুরায়রা রাযি, থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে বসা ছিলাম। আমাদের মধ্যে আবূ বকর ও উমর রাযি-ও ছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের মধ্যে থেকে উঠে চলে গেলেন। তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসতে বিলম্ব করলেন; এতে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম যে, আমাদের অনুপস্থিততে তিনি কোন বিপদে পড়লেন কিনা। আমরা বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিচলিতদের মধ্যে আমি ছিলাম প্রথম। তাই আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। তালাশ করতে করতে বনী নাজ্জার গোত্রের আনসারদের বাগানের কাছে পৌঁছালাম, আমি বাগানের চারদিকে ঘুরে কোন দরজা পেলাম না। হঠাৎ দেখতে পেলাম বাইরের কুয়া থেকে একটি ‘রব’ (ঝরণা, প্রণালী, নালা) বাগানের ভিতর প্রবেশ করেছে। আমি শেয়ালের মত সংকুচিত করে প্রণালীর পথে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে প্রবেশ করলাম। তিনি বললেন, আবূ হুরায়রা! আমি আরয করলাম, জি¦ হ্যাঁ ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অবস্থা কি? আমি আরয করলাম, আপনি আমাদের মধ্যে ছিলেন। তারপর আমাদের মধ্যে থেকে উঠে চলে এলেন। আপনার ফিরতে দেরি দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম যে, আমাদের অবর্তমানে আপনি কোন বিপদে পড়লেন কি না? এ আশংকায় আমরা সকলেই বিচলিত হয়ে পড়লাম। বিচলিতদের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রথম। আমি এ বাগানে এসে উপস্থিত হই। তারপর নিজেকে শিয়ালের মত সংকুচিত করে এ বাগানে প্রবেশ করি। আর সে সব লোক আমার পেছনে রয়েছেন।

তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) হে আবূ হুরায়রা বলে তাঁর পাদুকা জোড়া প্রদান করলেন, আর বললেন, আমার এ পাদুকা জোড়া নিয়ে যাও এবং বাগানের বাইরে যার সাথেই তোমার সাক্ষাত হয় তাকে এ সুসংবাদ শুনিয়ে দাও, যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই, সে জান্নাতী হবে। আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, বাইরে এসে প্রথমেই উমরের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হলো। তিনি বললেন, হে আবূ হুরায়রা! এ জুতা জোড়া কি? আমি বললাম, এ তো রাসূলুল্লাহ (সা) এর পাদুকা মুবারক। তিনি আমাকে এ দুটি দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, যার সাথে আমার সাক্ষাত হয়, সে যদি আন্তরিক বিশ্বাসে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তাকে যেন জান্নাতের সুসংবাদ দেই। একথা শুনে উমর রাযি. আমার বুকে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, আমি চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম। তখন তিনি বললেন, ফিওে যাও, হে আবূ হুরায়রা! আমি কাঁদো কাঁদো অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা) এর খিদমতে ফিরে এলাম। আর সাথে সাথে উমরও আমার পিছনে পিছনে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হে আবূ হুরায়রা! তোমার কি হয়েছে? আরয করলাম, উমর রাযি.-এর সাথে আমার দেখা হয়। আপনি যা বলে আমাকে পাঠিয়েছিলেন আমি তা উমরকে জানাই। এতে তিনি আমার বুকে আঘাত করলেন যে, আমি চিৎ হয়ে পড়ে যাই। আর তিনি আমাকে ফিরে আসতে বললেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন হে উমর! কিসে তোমাকে এ কাজে উত্তেজিত করেছে? তিনি উত্তর দিলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। আপনি কি আপনার পাদুকা মুবারকসহ আবূ হুরায়রাকে বলে পাঠিয়েছেন যে, তার সাথে যদি এমন লোকের সাক্ষাত হয়, যে আন্তরিকতার সাথে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও? রাসূল (সা) বললেন, হ্যাঁ। উমর রাযি. বললেন, এরূপ করতে যাবেন না। আমি আশংকা করি যে, লোকেরা এর উপরই ভরসা করে বসে থাকবে; আপনি তাদের ছেড়ে দিন, তারা আমল করুক। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আচ্ছা, তাদের ছেড়ে দাও।
একটি প্রশ্ন: দৃঢ় ঈমান এবং শাহাদাতাইনে বিশ্বাস স্থাপন করা অন্তনির্হিত একটি বিষয়। অন্য কেউ তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) শাহাদাতাইনে বিশ্বাসীদের প্রতি এই সুসংবাদ প্রদানের নির্দেশ দিলেন?
উত্তর: এটি ছিলো একটি ব্যাপক সুসংবাদ। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয় যে তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা জেনে তারপর তাকে সুসংবাদটি দিতে হবে।

একটি প্রশ্ন: হযরত আবু হুরায়রা রাযি. ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রতিনিধি বা দূত। দূতের বক্তব্য দূত প্রেরণকারী ব্যক্তির বক্তব্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে হযরত উমর রাযি. প্রকারান্তে রাসূল (সা) এর বক্তব্যের বিরোধীতা করলেন কীভাবে?

জবাব: প্রদত্ত এই নির্দেশ ওয়াজিব ছিলো না, বরং সাহাবায়ে কেরামকে খুশি করার জন্য ছিলো। হযরত মু‘আয রাযি. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের অন্যতম প্রমাণ। রহমাতুল লিলআলামীনের সীমাহীন দয়ার কারণে উম্মতের দুর্বলতার দিকটি গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু হযরত উমর রাযি. কর্তৃক তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় তিনি সচেতন হন এবং হযরত উমর রাযি. এর মতটিই তিনি আমলে আনলেন।

৫৫) ইসহাক ইবনে মানসূর রহ…আনাস ইবনে মালিক রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ও মু‘আয ইবনে জাবাল রাযি, একই বাহনে সাওয়ার হয়েছিলেন। এ অবস্থায় নবী করিম (সা) বললেন, হে মু‘আয ইবনে জাবাল! মু‘আয রাযি বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বান্দা হাযির, আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। রাসূল (সা) আবার বললেন, হে মু‘আয! মু‘আয উত্তর করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বান্দা হাযির, আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। রাসূল (সা) বললেন, যদি কোন বান্দা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল, তবে আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করবেন। মু‘আয রাযি. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ খবর লোকদের দিয়ে দিব কি, যাতে তারা সুসংবাদ পায়? রাসূল (সা) বললেন, তা হলে লোকেরা এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। পরে সত্য কথা গোপন রাখার গুনাহের ভয়ে মু‘আয রাযি. অন্তিমকালে এ খবর শুনিয়ে গিয়েছেন।

একটি প্রশ্ন: রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত মু‘আজ রাযি. কে এই হাদীসটি বর্ণনা করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও কেন তিনি তা মৃত্যুর পূর্বে অন্যদেরকে জানিয়ে গেলেন?

জবাব: গোপন করা একটি বড় গুনাহ। যার প্রমাণ স্পষ্ট হদীসেই রয়েছে। সেই গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে হাদীসটি জানিয়ে গেছেন।

প্রশ্ন: ‘ইলম’ গোপন করা যেমন গুনাহ ঠিক তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নির্দেশ অমান্য করাও গুনাহ। তাহলে তিনি দ্বিতীয় গুনাহটি বেছে নিলেন কেন?

উত্তর: রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিষেধাজ্ঞাটি হারাম কাজ হিসেবে ছিলো না। বরং তা ছিলো বিশেষ কল্যাণের প্রতি লক্ষ করে। তাছাড়া হযরত মু‘আজ রাযি. শেষ বয়সে একথা উপলব্ধি করতে পেরে ছিলেন যে, বিষয়টি মূলত সাধারণ মানুষের দিকে লক্ষ করে নিষেধ করা হয়েছিলো। যারা বিষয়টি জানলে আমল বিমূখ হয়ে যাবে। বিশেষ বিশেষ লোকের বেলায় সে আশাংকা নেই। তাই তিনি হাদীসটি বিশেষ কিছু লোকের কাছে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন।

৫৬) শায়বান ইবনে ফাররুখ রহ…মাহমূদ ইবনুর রাবী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি মদীনায় এসে ‘ইতবানের সাথে সাক্ষাত করে বললাম, আপনার কাছ থেকে একটা হাদীস আমার কাছে পৌঁছেছে। ইতবান রাযি. বললেন, আমার চোখে এক রোগ দেখা দিলে আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর খিদমতে খবর পাঠালাম যে, আমার একান্ত আকাঙ্খা, আপনি আমার কাছে তাশরীফ আনবেন এবং আমার গৃহে দু‘রাকাত নামায আদায় করবেন। আপনার নামায আদায়ের স্থানটিকে আমি নিজের জন্য নামায আদায়ের স্থান বানিয়ে নেব। তারপর আল্লাহ যাদের মরযূর করলেন, তাঁদের সাথে নিয়ে রাসূল (সা) তাশরীফ আনলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ঘরে ঢুকে নামায আদায় করতে থাকলেন। তাঁর সাহবীরা পরস্পর কথাবার্তা বলছিলেন। এক পর্যায়ে মালিক ইবনে দুখশুম-কে তাদের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু বানিয়ে নিলেন। তাঁরা ইচ্ছা পোষণ করছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মালিক ইবনে দুখশুম-এর জন্য বদ দু‘আ করুন যেন সে ধ্বংস হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) নামায সম্পন্ন করলেন এবং বললেন, সে কি সাক্ষ্য দেয় না যে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল? তাঁরা আরয করলেন, সে এ কথা বলে বটে, কিন্তু তার অন্তরে এটা নেই। রাসূল (সা) বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল’ এ কথার সাক্ষ্য দেবে আর সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে কিংবা আগুন তাকে দগ্ধ করবে এমন হবে না। আনাস রাযি. বলেন, হাদীসটি আমাকে বিস্মিত করেছিল। আমি আমার পুত্রকে বললাম, হাদীসটি লিখে নাও। সে তা লিখে রাখল।

৫৭) আবূ বকর ইবনে নাফি ‘আল-আবদী রহ…আনাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, ইতবান রাযি. অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (স) এর কাছে এ বলে খবর পাঠালেন. আপনি আমার ঘরে তাশরীফ আনুন এবং আমার জন্য একটি নামাযের স্থান নির্দিষ্ট করে দিন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাশরীফ আনলেন। ইতবানের গোত্রের লোকজনও হাযির হলো। তখন মালিক বিন দুখশুম নামক এক ব্যক্তির কথা সেখানে উল্লেখ করা হলো…তারপর বর্ণনাকারী সুলায়মান ইবনে মুগীরার অনুরূপ হাদীসটি রিওয়ায়াত করেন।