সুরা-বাকারাহ্
আয়াত-২৮৬
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়াল
وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًا فَادَّارَأْتُمْ فِيهَا ۖ وَاللَّهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ
(৭২) আর যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে খুন করিলে এবং উহার জন্য একে অন্যকে দায়ী করিতে লাগিলে আর আল্লাহ্ এই বিষয়টি প্রকাশ করিতে ইচ্ছুক ছিলেন যাহা তোমরা গোপন রাখিতে চাহিতেছিলে।
(৭৩) অনন্তর আমি বলিলাম, উহাকে ইহার কোন এক টুকরা দ্বারা স্পর্শ কর; এইরূপেই আল্লাহ্ জীবিত করিবেন মৃতকে এবং তোমাদিগকে দেখান স্বীয় নিদর্শন, এই আশায় যে, তোমরা বৃদ্ধি প্রয়োগ করিবে।
(৭৪) এমন এমন ঘটনার পর তোমাদের হৃদয় তবুও শক্তই রহিয়া গেল, উহার দৃষ্টান্ত পাথরের ন্যায় বা আরও বেশি কঠিন; আর কতক পাথর তো এমন আছে যাহা হইতে নহর সমুহ উত্থলিয়া প্রবাহিত হয়; আর উহার মধ্যে কতক এমনও আছে যাহা ফাটিয়া যায় এবং উহা হইতে পানি বাহির হয়; আর উহাদের কতক এমনও আছে যাহা আল্লাহর ভয়ে উপর হইতে নীচের দিকে গড়াইয়া পড়ে; এবং আল্লাহ্ বেখবর নহেন তোমাদের কার্য সম্বন্ধে।
أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
(৭৫) তোমরা কি এখনও আশা রাখ যে, তোমাদের কথায় ঈমান আনিবে? অথচ তাহাদের মধ্যে কতক এমন লোকও গত হইয়াছে যাহারা আল্লাহ্ তায়ালার কালাম শুনিত, অতঃপর উহাকে বিকৃত করিত উহাকে বুঝিবার পর অথচ তাহারা জানিত।
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ قَالُوا أَتُحَدِّثُونَهُم بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ لِيُحَاجُّوكُم بِهِ عِندَ رَبِّكُمْ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
(৭৬) আর যখন তাহারা মিলিত হয় মুমিনদের সহিত-বলে, আমরা ঈমান আনিয়াছি, আর যখন গোপনে যায় ইহাদের কেহ ইহুদীর নিকট তখন উহারা বলে, তোমরা কি মুসলমানদেরে বলিয়া দাও আল্লাহ্ তোমাদের নিকট যাহা প্রকাশ করিয়াছেন; পরিণামে তাহারা তোমাদিগকে তর্কে পরাজিত করিবে যে, এই বিষয়টি আল্লাহর নিকট রহিয়াছে। তোমরা কি বুঝ না?
শানে নুযুল:
১। স্পর্শ করাইবার সঙ্গেই নিহত ব্যক্তি জীবিত হইয়া হত্যাকারীর নাম নির্দেশ করিল, এবং তৎক্ষণাৎ পুনরায় মরিয়া গেল। (বঃকোঃ)
২। পাথর খোদার ভয়ে নীচের দিকে নামিয়া আসা সম্বন্ধে কাহারও মনে সন্দেহ হইতে পারে যে, পাথরের তো ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং বুদ্ধি নাই, ভয় করিবে কেমন করিয়া? এস্থলে বুঝিতে হইবে যে, ভয়ের জন্য বুদ্ধির আবশ্যকতা নাই। পর্যবেক্ষনে দেখা যায় অনেক ইতর প্রাণীর মধ্যে ভয় আছে। অবশ্য ভয়ের জন্য ইন্দ্রিয়ানুুভূতীর আবশ্যক। আর ইন্দ্রিয়ানুভূতী নির্ভর করে জীবনী শক্তির উপর।
সম্ভবতঃ পাথরের মধ্যে অতি সুক্ষ এবং দুর্লক্ষ্য জীবনী শক্তি রহিয়াছে যাহা আমরা উপলব্ধি করিতে পারিতেছিনা।
৩। ফঃ যাহারা এমন বে-আদব ও স্বার্থপর তাহারা কখনও কাহারও কথায় মন্দ কাজ হইতে বিরত হয় না। (বঃকোঃ)
(৭৭) তাহারা কি জানে না যে, আল্লাহ সবই অবগত আছেন যাহা তাহারা গুপ্ত রাখে এবং উহাও যাহা প্রকাশ করে।
(৭৮) আর তাহাদের মধ্য বহু মূর্খ আছে, যাহারা মনভুলান কথা ভিন্ন কিতাবের আর কিছুরই জ্ঞান রাখে না, উহারা আর কিছুই নহে- শুধু অলীক কল্পনাসমূহ রচনা করিয়া থাকে।
(৭৯) অতএব, অত্যন্ত অমঙ্গল হইবে তাহাদের যাহারা লিখিয়া লয় কিতাব নিজেদের হাতে, অতঃপর বলে, ইহা আল্লাহর তরফ হইতে উদ্দেশ্য, ইহা দ্বারা সামান্য অর্থ উপার্জন করিবে; সুতরাং তাহাদের ভীষন সর্বনাশ হইবে তাহাদের হাত যাহা কিছু লিখিয়া লইত, তদ্দরুন তাহাদের আরও ভীষন সর্বনাশ হইবে যাহাকিছু তাহারা উপার্জন করিত তদ্দরুন।
(৮০) আর ইহুদীরা বলিল, কখনও অগ্নি আমাদিগকে স্পর্শ করিবে না গনণীয় কয়েকদিন ব্যতীত। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ্ হইতে কোন ওয়াদা লইয়াছো? যাহাতে আল্লাহ্ তাঁহার ওয়াদা খেলাপ করিবেন না অথবা আল্লাহর উপর এমন বাক্য আরোপ করিতেছ যাহার কোন জ্ঞান-প্রসুত প্রমান তোমাদের নিকট নাই।
(৮১) হাঁ, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় দুষ্কার্য করে, এবং তাহাকে তাহার পাপসমুহ ঘিরিয়া ফেলে বস্তুতঃএরূপ লোকই দোযখীহয়, ইহারা তথায় অনন্তকাল থাকিবে।
শানে নুযুল:
১। মুনাফিক ইহুদীরা কখন কখন নিজেদের ঈমানের সত্যতা প্রকাশের জন্য মুসলমানদের নিকট এই সত্য কথাটি বলিয়া ফেলিত যে, তওরাতে মোহাম্মদ (দঃ)-এর নুবুওয়্যাত সম্বন্ধে সংবাদ রহিয়াছে এবং কোরআন মজীদ সম্বন্ধেও উল্লেখ আছে। ইহাতে অন্যান্য ইহুদিরা তাহাদিগকে তিরষ্কার করিত। (বঃকোঃ)
২। মূর্খ ইহুদীরা তাহাদের আলেমদের নিকট হইতে যে শিক্ষা পাইত তাহা ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও বিকৃত। আবার তাহাদের বোধ শক্তিও ছিল অল্প। কাজেই অলীক কল্পনা ভিন্ন প্রকৃত জ্ঞান লাভ করার কোন উপাইয় তাহাদের ছিল না। (বঃকোঃ)
৩। ইহুদী আলেমরা জনসাধারনের প্রয়োজন অনুযায়ী মিথ্যা মাসআলা তৈরী করিয়া তাহাদের নিকট হইতে কিছু অর্থ লাভ করিত ও মানমর্যাদাও পাইত, এই উদ্দেশ্যে তাহারা তওরাতের মধ্যে নানাপ্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিত। (বঃকোঃ)
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
(৮২) আর যাহারা ঈমান আনে এবং নেক কাজ করে এই শ্রেণীর লোকই বেহেস্তবাসী হয়, তাহার তথায় অনন্তকাল থাকিবে।
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِّنكُمْ وَأَنتُم مُّعْرِضُونَ
(৮৩) আর যখন আমি লইলাম প্রতিশ্রুতি বনী-ইসরায়ীল হইতে যে, এবাদত করিও না আল্লাহ্ ব্যতীত, আর উত্তমরূপে মা-বাপের খেদমত করিবে এবং আত্নীয়দেরও, ইয়াতীমদেরও, আর মিসকীনদেরও, আর সর্বসাধারনের সহিত সুন্দররূপে কথা বলিবে, আর কায়েম করিবে নামায ও আদায় করিতে থাকিবে যাকাত, অনন্তর তোমরা সকলেই উহা ভঙ্গ করিলে, অল্প কয়েকজন ব্যতীত, আর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা তো তোমাদের চিরাচরিত অভ্যাস।
(৮৪) আর আমি যখন তোমাদিগ হইতে এই প্রতিশ্রুতি লইলাম যে, তোমরা পরষ্পর রক্তপাত করিবে না এবং বিতারিত করিবে না স্বগোত্রীয় লোকদিগকে নিজ দেশ হইতে; অতঃপর তোমরা অঙ্গীকারও করিলে এবং অঙ্গীকারও এনরূপ যেন তোমরা সাক্ষ্য দিতেছ।
ثُمَّ أَنتُمْ هَـٰؤُلَاءِ تَقْتُلُونَ أَنفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِّنكُم مِّن دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ عَلَيْهِم بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِن يَأْتُوكُمْ أُسَارَىٰ تُفَادُوهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ ۚ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
(৮৫) অতঃপর তোমাদের অবস্থা হইল এই-পরষ্পর হত্যাকান্ডে লিপ্ত আছ এবং বাহির করিয়া দিতেছ একদল অন্য দলকে নিজেদের দেশ হইতে, ঐ সমস্ত স্বজনের বিরুদ্ধে সহায়তা করিতেছ পাপ ও অন্যায় মূলক; আর যদি তাহাদের মধ্য হইতে কেহ তোমাদের নিকট বন্দী হইয়া আসে, তবে মুক্তিপণ দিয়া তাহাদিগকে মুক্ত করাইয়া দেও; অথচ তাহাদিগকে নিজ দেশ হইতে বিতাড়িত করাও তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ; তবে কি তোমরা ঈমান রাখ কিতাবের কোন কোন অংশের প্রতি এবং অবিশ্বাস কর কোন কোন অংশকে? সুতরাং কি শাস্তি হইতে পারে তাহার যে তোমাদের মধ্য হইতে এরূপ করে, পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা এবং কিয়ামত দিবসে ভীষণ আযাবে নিক্ষিপ্ত হওয়া ব্যতীত? আর আল্লাহ্ তাআলা বে-খবর নহেন তোমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে।
শানে নুযুল:
১। এই অল্প সংখ্যক লোক তাহারাই যাহারা হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত মূসা (আঃ) এর শরীয়তের উপর কায়েম ছিল এবং তওরাত রহিত হওয়ার পর শরীয়তে মোহাম্মদীর অনুগামী হইল। (বঃকোঃ)
২। মদীনাবাসীদের মধ্যে আওস ও খায্রাজ নামে দুইটি প্রতিমাপূজক এবং বনী-কুরাইযা ও বনী-নাযীর নামে দুইটি ইহুদি সম্প্রদায় ছিল। আওস এবং খায্রাজের মধ্যে পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহ লাগিয়াই থাকিত। আওসের সহিত বনী-কুরাইযা এবং খায্রাজের সহিত বনী-নাযীর গোত্র বন্ধুত্ব চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। ইহুদীদের উভয় সম্প্রদায়ই নিজ নিজ বন্ধু-সম্প্রদায়কে যুদ্ধ বিগ্রহে সাহায্য করিত। অতএব, ইহুদীদের লোক এসমস্ত যুদ্ধে নিহত, দেশান্তর বাব ন্দী হইত। অবশ্য ইহুদীদের মধ্যে কেহ বন্দী হইলে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ বন্ধু গোত্রকে অর্থ দ্বারা রাযী করিয়া উক্ত বন্দীকে মুক্ত করাইয়া দিত। কেহ জিজ্ঞাসা করিলে বলিত,বন্দীকে মুক্ত করা ধর্মীয় কর্তব্য। কিন্তু হত্যা ও দেশান্তর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলে বলিত,বিপদে বন্ধুর সাহায্য না করিয়া পারি না। এখানে ইহারাই নিন্দা করা হইয়াছে। (বঃকোঃ)
(৮৬) ইহারাই তাহারা যাহারা দুনিয়াকে গ্রহন করিয়াছে আখেরাতের বদলে; সুতরাং তাহাদের আযাবও কম হইবে না, কেহ তাহাদের সহায়তাও করিতে পারিবে না।
(৮৭) আর আমি দান করিলাম মূসাকে কিতাব এবং তাঁহার পর ক্রমান্বয়ে পাঠাইলাম বহু পয়গম্বর,আর দান করিলাম ঈসা ইব্নে-মারইয়ামকে প্রকাশ্য দলীলসমূহ, আর তাঁহাকে রূহুল কুদুস্ দ্বারা সাহায্য করিলাম; ইহা কি বিস্ময়কর নহে যে, যখনই তোমাদের নিকট আনিলেন কোন রাসুল তোমাদের অবাঞ্চিত আহকাম (তখনই) তোমরা অহংকার করিতে লাগিলে! ফলে কাহাকেও মিথ্যাবাদী বলিলে, আর কাহাকেও তো হত্যাই করিয়া ফেলিতে।
(৮৮) আর তাহারা বলে, আমাদের অন্তঃকরণ সংরক্ষিত; বরং তাহাদের কুফরীর কারনে তাহাদের উপর খোদার লা’নৎ রহিয়াছে; এবং তাহারা অতি সামান্য পরিমাণই ঈমান রাখে।
(৮৯) আর যখন তাহাদের নিকট এমন কিতাব আসিল আল্লাহর তরফ হইতে যাহা তাহাদের সঙ্গীয় কিতাবের সত্যতা প্রমাণকারী, অথচ ইতিপূর্বে তাহারা উহার বর্ণনা করিত কাফেরদের নিকট, অতঃপর যখন তাহাদের নিকট আসিল সেই পরিচিত কিতাব, তখন তাহারা উহাকে অস্বীকার করিয়া বসিল; সুতরাং খোদার লা’নৎ হউক এরূপ কাফেরদের উপর।
শানে নুযুল:
১। এস্থলে ইহুদীদের দুইটি শাস্তির উল্লেখ করা হইয়াছে। একটি পার্থিব অবমাননা ও লাঞ্চনা। তাহাদের এই শাস্তি হুযুর (দঃ) এর জীবিতকালেই মুসলমানদের সহিত চুক্তি ভঙ্গ করার অপরাধে বনী-কুরাইযা ধ্বত ও নিহত হয়। আর বনী-নাযীর অপরিসীম লাঞ্চনার সহিত শাম দেশের দিকে বিতাড়িত হয়। দ্বিতীয় শাস্তি আখেরাতের আযাব। (বঃকোঃ)
২। কোরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে জিব্রাঈল (আঃ) কেই ‘রূহুল কুদুস’ বলা হইয়াছে। আর জিব্রাঈল আলাইহিস্সালাম এর দ্বারা ঈসা (আঃ) বিভিন্ন প্রকারে সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। (বঃকোঃ)